Friday, July 8, 2011

যৌনতার প্রকৃতি, প্রকৃতির যৌনতা

পার্থ চক্রবর্তী

এই লেখা মানবিক যৌনতাকে ঘিরে আজকাল যে যে বিতর্কগুলি গড়ে উঠেছে, গজিয়ে উঠেছে তার একটি বিশেষ পরিসরকে নিয়ে। মানুষের বিভিন্নরকম যৌন আচরণ কতটা প্রাকৃতিক (পড়ুন স্বাভাবিক) আর কতটা অ-প্রাকৃতিক, তা নিয়ে। এই লেখায় আমরা মানবিক যৌনতাকে বহুবচন হিসেবে ধরে নিয়েছি, মানুষের যৌন আচরণের বহুত্বকে (সমকামী, বিসমকামী, রূপান্তরকামী ইত্যাদি) সামাজিক বাস্তবতা হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছি। এই স্বতঃসিদ্ধ থেকে আমরা দেখতে চাইব প্রকৃতি কী ভাবে যৌনতায়, যৌনতার আলোচনায় ঢুকে পড়ে। তর্কটা মূলত ঘুরপাক খায় সমকামিতাকে ঘিরে - একদল বলেন যে বিসমকামিতা প্রাকৃতিক, তাই স্বাভাবিক; অপরপক্ষ বলেন যে প্রকৃতিতে সমকামিতার উদাহরণও অনেক, তাই সমকামিতাও প্রাকৃতিক। প্রথম পক্ষে যেমন "গোঁড়া' কোরান-বাইবেল-মনুবাদীরা আছেন, তেমনি আছে "উদার' বিজ্ঞান, যেমন "ফরেন্সিক মেডিসিন' বা "আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েসন'। রাজনৈতিক পরিসরে "ফায়ার' সিনেমা বন্ধ করা নিয়ে অবশ্য "গোঁড়া'-দের বিরূদ্ধতা করেছেন অনেকেই (আমরাও করেছি) কিন্তু শতাব্দী জুড়ে ডাক্তারি বিজ্ঞানে সমকামিতার "অপ্রাকৃতিক যৌন-অপরাধ'-এর তত্ত্বায়ন হয়ে চলা নিয়ে বিশেষ আলোচনা আমরা শুনি নি (২০০৯ সালে আদালত সমকামিতাকে অপরাধ হিসেবে বাতিল করলেও স্বদেশে রচিত ফরেন্সিক মেডিসিন-এর বইয়ে অবশ্য এখনও "অপ্রাকৃতিক যৌন-অপরাধ'-এর বৈজ্ঞানিক লিস্টিতে বিসটিয়ালিটি, ওরাল সেক্স ইত্যাদির সাথে সমকামিতা দিব্যি রয়ে গেছে)।

অপরপক্ষেও আছেন অনেকেই - বৈজ্ঞানিক, সমাজতাত্ত্বিক থেকে রাজনৈতিক কর্মীরা। দুই পক্ষের যুক্তি থেকে অবশ্য একটা সাধারণ বিষয় উঠে আসে, একটা স্বতঃসিদ্ধ উঠে আসে - যা কিছু প্রাকৃতিক, তা-ই স্বাভাবিক এবং তাই যেন বৈধ। অথবা একটু অন্যভাবে বললে, যা কিছু প্রাকৃতিক "নিয়ম' মাফিক চলে, তাই বৈধ। ফলে এই তর্কে আরো একটি স্বতঃসিদ্ধ এসে গেল - প্রকৃতিতে "নিয়ম' আছে আর মানুষের সমাজ যেন সেই নিয়ম মেনে চললে বৈধতা পাবে। এই যুক্তিতে মানুষের সামাজিক গঠনে আর ব্যবহারে যদি প্রাকৃতিক "নিয়ম'গুলি ঠিকঠাক প্রয়োগ করা যায়, তা হলে তৈরি হবে এক সুস্থ, স্বাভাবিক, আদর্শ সমাজ।

এই লেখায় আমরা নির্দিষ্টভাবে দুটি প্রসঙ্গকে আলোচনায় আনছি, প্রশ্ন করছি। প্রথম, প্রকৃতির কোন ধারণায় মানুষের যৌনতার বৈধতার গল্প বলা হয়; দ্বিতীয়, মানুষ আর পশুর যৌন আচরণকে একরকম, এক করে দেখার প্রবণতা থেকে কিভাবে মানুষের যৌনতার বৈধতার গল্প তৈরি হয়।

১। প্রথমে দেখে নেওয়া যাক এখানে প্রকৃতি বলতে আমরা ঠিক কী বুঝছি। উত্তর উপনিবেশের ভূগোলে আর ইতিহাসে "আমরা' পশ্চিমের/উত্তরের মডেলেই ভাবি, ভাবতে শিখি - আমাদের প্রকৃতি ভাবনাও তাই পশ্চিমকেই একভাবে রিপ্রেজেন্ট করে। পশ্চিমী ধারণায় প্রকৃতি হল মানুষ আর মানবিক কার্যকলাপ বাদ দিয়ে আর বাদবাকি সবকিছু - জীবজন্তু, গাছপালা, পাথর-মাটি, প্রোটন-নিউট্রন, চাঁদ-সূর্য (পশ্চিমে প্রকৃতির ধারণা আর তার ক্রিটিক নিয়ে বিশদ আলোচনার জন্য লেখকের "তেপান্তর' পত্রিকায় (সংখ্যা ৮, ২০১০) "পুনর্ভাবনায় প্রকৃতির বিজ্ঞান ও রাজনীতি' লেখাটি দেখতে পারেন)। যৌনতা প্রাকৃতিক কি না, সেই আলোচনায় অবশ্য প্রকৃতি এত ব্যাপক অর্থে আমাদের কাছে আসে না - আসে একটু ছোট হয়ে, শুধুমাত্র জৈব প্রকৃতির প্রতিনিধি হিসেবে। তার মানে জীবজন্তু, গাছপালার যৌনতা আর মানুষের যৌনতার মিল/অমিলের হিসেবের মধ্যে দিয়ে।

এবার একটু জৈব প্রকৃতির যৌনতা বলতে আমরা কী বুঝছি, দেখে নেওয়া যাক। আমরা বিজ্ঞানের বই খুলে দেখছি যে জৈব জগতের বেশিরভাগটাতেই যৌনতা ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে - প্রথমেই উদ্ভিদদের বাদ দিতে হচ্ছে, কারণ গাছপালার সাথে মানুষের তুলনাটা ঠিক হবে না; তারপর দেখা যাচ্ছে যে অযৌন আর "উভ'লিঙ্গ প্রাণীদের সংখ্যা, ভ্যারিয়েশন সবকিছুই যৌন প্রাণীদের থেকে অনেক অনেক বেশি। তা হলে মানুষের যৌনতাকে বুঝতে জৈব প্রকৃতির এক সংখ্যালঘু অংশকে, যারা মূলত ডারউইনিয় বিবর্তনে মানুষের মত অপেক্ষাকৃত নাবালক, তাদের দিয়ে বুঝতে হবে। তাই সমকামিতার পক্ষে আর বিপক্ষে যারা কথা বলেন, তারা আদতে প্রকৃতি নিয়ে বলেন না - প্রকৃতির এক ছোট্ট, খর্বিত প্রতিনিধির কথা বলেন; কিছু স্তন্যপায়ী প্রাণীর যৌন আচরণের কথা বলেন; বাঘ-সিংহ, গোরু-মোষ, জেব্রা-জিরাফের যৌনতার কথা বলেন। যেন, মানুষের যৌন আচরণ এই সব প্রাণীদের ইকুইভ্যালেন্ট, সমার্থক। সম্প্রতি প্রকাশিত অভিজিৎ রায়-এর "সমকামিতা : একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান' (শুদ্ধস্বর, ঢাকা; ২০১০) বইটি এইরকম একটি ধারণাকে সমর্থন করে লেখা। লেখক বইয়ের ভূমিকাতেই তাঁর অবস্থান বর্ণনা করেছেন - "এই বইয়ের মাধ্যমে প্রথম বারের মত বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য অজ্ঞতার চাদর সরানোর প্রয়াস নেয়া হয়েছে, সর্বাধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমাণ হাজির করে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে, সমকামিতা কোন বিকৃতি বা মনোরোগ নয়, এটি যৌনতারই একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি'। তিনি এই বইয়ে বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে সমকামিতার একটা তালিকাও দিয়েছেন। অপরদিকে পশ্চিমের এক উদাহরণে আমরা "অ্যানিমাল হোমোসেক্সুয়ালিটি'র প্রদর্শনীও হতে দেখি ( http://www.nhm.uio.no/besokende/skiftende-utstillinger/againstnature/i
ndex-eng.html
 ); প্রদর্শনীর নামটিও উস্কানিমূলক " Against Nature ?' এবং সেখানে কর্তারা প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করলেন এই ভাবে- " help to de-mystify homosexuality among people ... we hope to reject the all too well known argument that homosexual behaviour is a crime against nature. ' এই প্রেক্ষিতে আমাদের প্রশ্নগুলি খুব সহজ - সমকামিতার পক্ষে আর বিপক্ষে থেকে যারা প্রকৃতির কাছে "আবেদন' করছেন, সেই প্রকৃতি কোন প্রকৃতি? এবং তা কি আদতেই প্রকৃতি? আমরা দেখলাম যে এই প্রকৃতি যেন এক "বানিয়ে তোলা' প্রকৃতির ধারণা। (একটি (অ)প্রাসঙ্গিক গল্প - রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গে এই "বানিয়ে তোলা'র কনসেপ্টটা নিয়ে এসেছিলেন; তাঁর কাছে "দেশ' নামের ধারণাটা এসেছিল "ভৌগোলিক অপদেবতা' হিসেবে, যেখানে দেশ মানুষের চিন্তাকে সীমাবদ্ধ করে, নিয়ন্ত্রণ করে, নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে। "চার অধ্যায়'-এ অতীন একভাবে থিওরায়িজ করে রবীন্দ্রনাথকে - "দেশ উপাধি দিয়ে যার মধ্যে আমার বাসা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলে তোমাদের দলের বানানো দেশে - অন্যের পক্ষে যাই হোক আমার স্বভাবের পক্ষে সেই তো খাঁচা। আমার আপন শক্তি তার মধ্যে সম্পূর্ণ প্রকাশ পায় না বলেই অসুস্থ হয়ে পড়ে, বিকৃতি ঘটে তার, যা তার যথার্থ আপন নয় তাকেই ব্যক্ত করতে গিয়ে পাগলামি করে, লজ্জা পাই, অথচ বেরোবার দরজা বন্ধ... আপন দেশে আপন স্থান নেবার দায় ছিল আপন শক্তিতেই, সে শক্তি আমার ছিল। কেন তুমি আমাকে সেকথা ভুলিয়ে দিলে?' এই বিষয়টি নিয়ে চমৎকার আলোচনা করেছেন আশীষ নন্দী তাঁর " Illegitimacy of Nationalism ' কিতাবে।) এবার এই বানিয়ে তোলা প্রকৃতির মধ্যেই যেন যুক্তিকে মাপমতো কেটে ছেঁটে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। যদি সমকামিতা এক সামাজিক বাস্তবতা হয়, তা হলে এর সমর্থনকারীরা আদতে বিরোধীদের (অ)যুক্তির জালেই আটকে গেলেন - এক অসম্ভব প্রকৃতির ধারণায় হ্যাঁ বললেন। প্রকৃতির ধারণাকে প্রশ্ন না করলে কোন বিতর্ক (নৈয়ায়িকরা যাকে বলেন "বাদ') হওয়া মুশকিল যেখানে দুই পক্ষ তাদের নিজ নিজ কিন্তু বিপরীত অবস্থান নিতে পারেন।

২। এবার দ্বিতীয় সমস্যাটা একটু দেখে নেওয়া যাক। এই তর্কে মানুষের যৌন আচরণকে ধরে নেওয়া হচ্ছে পশুর মতো; মানুষ যেহেতু একধরণের পশু, তাই ধরে নেওয়া হচ্ছে পশুরা যে ভাবে যৌনতা প্র্যাকটিস করে, মানুষও যদি তাই করে, তা হলে তা হবে প্রাকৃতিক, স্বাভাবিক। কিন্তু একটু ভাবলেই দেখা যাবে যে আদতে বিষয়টা পুরোপুরিই উলটো। মানুষই পশুদের যৌনতা পর্যবেক্ষণ করে, তাই নিয়ে পড়াশুনো করে ইউনিভার্সিটিতে, টিভিতে দেখে সপরিবারে। যদিও কোন পশু মানুষের যৌনতা স্টাডি করেছে বলে জানা নেই। তাই পশুর যৌনতার যে নৃতাত্ত্বিক বর্ণনাকে প্রাকৃতিক বলে চালানো হচ্ছে, তা আসলে মানুষের তৈরি করা এক গল্প, মানুষের মতো করে তৈরি করা এক গল্প। পশুর যৌনতা তাই যেন মানবিক যৌনতার এক প্রসার, এক্সটেনশন মাত্র। গত একশ বছরের বিজ্ঞানের ইতিহাস খুঁড়ে বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক ডোনা হারাওয়ে আমাদের দেখিয়েছেন কিভাবে শিম্পাঞ্জী, বাঁদর ইত্যাদি "প্রাইমেট'গোষ্ঠীর পশুদের স্টাডির মধ্যে মিলেমিশে থেকেছে মানবিক যৌনতা, শ্রেণী আর জাতির ধারণা (উৎসাহী পাঠিকা/পাঠক ডোনা হারাওয়ে-র " Primate Visions ' বইটি উলটে পালটে দেখতে পারেন)। তিনি তাঁর " Simians, Cyborgs, and Women ' নামের অন্য একটি বইতে প্রাইমেটদের নৈসর্গীকরণের ( naturalization ) ধারণাকে আরো বিস্তৃত করেছেন; প্রাইমেটলজির জ্ঞানের প্রেক্ষিতে তাঁর মন্তব্য - " Sciences (also) act as legitimating meta-language that produce homologies between social and symbolic systems. That is acutely true for the sciences of the body and the body politic...It is not an accident of nature that our social and evolutionary knowledge of animals, hominids and ourselves has been developed in functionalist and capitalist economic terms '। হারাওয়ে এখানে বিজ্ঞানকে ভাবছেন এক বিশেষ "কালচারাল প্র্যাকটিস' হিসেবে যা আবার একইসাথে "প্র্যাকটিকাল কালচার'-ও বটে। হারাওয়ে প্রাইমেটলজিকে তাই " the terrain of the contested zone ' হিসেবে বর্ণনা করবেন। আমরাও লক্ষ্য করি, বিজ্ঞানের সবরকম নজরদারিতে কোনওভাবে পূর্বনির্ধারিত তত্ত্ব ঢুকে পড়ে (এখানে মানুষের যৌনতার "স্বাভাবিক'তা), সাবজেকটিভিটি ঢুকে পড়ে। বিজ্ঞানের দর্শনে এই বিষয়টি theory-laden nature of observation হিসেবে চালু আছে। প্রকৃতির যৌনতায় যেন যৌনতার প্রকৃতি-র ধারণা মিশে আছে, ব্যাপ্ত হয়ে আছে। তাই শিম্পাঞ্জীর যৌনতায় কেউ খুঁজে পান যৌনকর্মীকে, কেউবা খুঁজে পান র‌্যাশানাল অর্থনৈতিক বিষয়ীকে, কেউ খুঁজতে চান মানবিক পুরুষতন্ত্রের বৈধতা, কেউ খুঁজে দেখেন সমকামিতা, কেউবা বিসমকামিতা। ফলে যখন কেউ বলেন পশুর যৌনতা (সমকামী বা বিসমকামী) প্রাকৃতিক, তখন তিনি পশুর নাম দিয়ে মানুষের কথা বলছেন, মানুষের কথাই বলছেন, আদতে নিজের কথা বলছেন, যৌনতা নিয়ে নিজের রাজনৈতিক অবস্থানের কথা বলছেন। সমকামিতার সামাজিক বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়ে আমরা তাই আর একটা সহজ প্রশ্ন করতে চাইছি - প্রাকৃতিক, স্বাভাবিক যৌন আচরণের নামে আমরা কি আসলে আমাদের ভাবনা পশুদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছি? আর এই চাপিয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে কি এক বৃত্তাকার যুক্তির মধ্যে ঢুকে পড়ছি না? অন্য যৌনতার ভাবনায় প্রকৃতির কাছে আবেদনের পরিসরটা বোধহয় এখন অন্য ভাবে ভাবার সময় এসেছে।

0 মন্তব্য(সমূহ):

Post a Comment

নারী পুরুষের কামলিলা দুনিয়া

বাৎসায়ন কামসূত্র

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More